সেবা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে

চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। পাশাপাশি তাঁদের অনেকেরই কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) নেওয়া হচ্ছে। এতে হাসপাতালগুলোতে জনবলসংকটের ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। সেবা বন্ধ করার ঘটনাও ঘটছে। অভিযোগ উঠেছে, পরিকল্পনা ও আগাম ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতি এমন হয়েছে। তবে সুরক্ষা ও বিশেষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সেবা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পেশাজীবী চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বুধবার বিকেল পর্যন্ত চিকিৎসকসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৩০। এর মধ্যে চিকিৎসক ১৮২ জন, নার্স ৬৬ জন এবং টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ডবয়, আয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ১৮২ জন।

অন্যদিকে প্রতিদিনই আক্রান্ত ব্যক্তি বা রোগীর সংস্পর্শে আসছেন চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। এঁদের একটি অংশ কোয়ারেন্টিনে যাচ্ছেন। যদিও এঁদের কোনো পূর্ণাঙ্গ হিসাব নেই। তবে বিএমএর মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই সংখ্যা ইতিমধ্যে সংক্রমিত হওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের চেয়ে কম নয়। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসকসহ সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষিত না থাকলে বাকিদের সুরক্ষাও বিঘ্নিত হবে।

কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে অন্য রোগের সেবাও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। বছরের এই সময় মানুষের মধ্যে ডায়রিয়ার সংক্রমণ দেখা যায়। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। সর্দি, কাশি, জ্বরেরও মৌসুম এখন। এই সময় বজ্রপাতের ঘটনাও ঘটে। এমন সময় করোনা পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী কমে গেলে মানুষ বিপদে পড়বে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩৮ জন চিকিৎসক ও ১২ জন নার্স সংক্রমিত হয়েছেন বলে হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে পুরো হাসপাতালের ওপর। সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি কমেছে। ময়মনসিংহ বিভাগে চিকিৎসক, নার্সসহ ১২৭ জন, বরিশালে ২৬ জন চিকিৎসক, ৩৩ জন নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং ২০৯ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক কোয়ারেন্টিনে।

ঢাকা মেডিকেল, রাজশাহী মেডিকেল, খুলনা মেডিকেল, বরিশাল মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অনেক বড়। এসব হাসপাতালে প্রতিদিন অনেক রোগী আসে। হাসপাতালে রোগী, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগীর দর্শনার্থীদের ব্যাপক ভিড় থাকে। এসব হাসপাতালে সংক্রমণ ঘটলে তা একটি বিভাগ কিংবা একটি স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে না। পুরো প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

বৈশ্বিক মহামারির শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসকসহ সম্মুখসারির অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষিত না থাকলে বাকিদের সুরক্ষাও বিঘ্নিত হবে।

বাস্তবে সুরক্ষার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে হাসপাতালে। একটি বিভাগে সেবা বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি সেবা বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর করোনা শনাক্ত হয়। এরপর ওই বিভাগের চিকিৎসক ও নার্সদের কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার কাজী রশীদ উন নবী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই বিভাগের ৩৮ জন চিকিৎসক ও ১২ জন নার্সকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।’ ওই বিভাগের চিকিৎসা চলছে কীভাবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, ‘গাইনি বিভাগে আমরা কোনো রোগী ভর্তি করছি না। সেবা বন্ধ রেখেছি। শুধু আউটডোর (বহির্বিভাগ) খোলা রেখেছি।’

অনেকে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকির বিষয়টি আমলেও নিচ্ছেন না। এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগ থেকে।

ঢাকা মেডিকেলের গাইনি বিভাগে ছয়টি ইউনিট। এই ছয়টি ইউনিটের একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিকেলের এই বিভাগে জটিল প্রসূতি রোগীর চাপ অন্য সময়ের চেয়ে বেড়েছে। অন্য অনেক জায়গায় সেবা বন্ধ হওয়ার কারণে রোগী এখানে আসছে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মতো কোভিড-১৯ প্রবণ এলাকা থেকেও রোগী আসা অব্যাহত আছে। এখনো কোনো সেবা বন্ধ হয়নি।

তবে ঢাকা মেডিকেলের গাইনি বিভাগের একটি ইউনিটে ১১ এপ্রিল একজন রোগীর কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদেরও পরে কোভিড-১৯ ধরা পড়ে। চারজন নার্সও সংক্রমিত হন। কিন্তু ওয়ার্ডবয়দের পরীক্ষা করা হয়নি। গাইনি অনকোলোজি ইউনিটে একজন চিকিৎসক ও দুজন নার্স আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। তিন নম্বর ইউনিটে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে অস্ত্রোপচার হয়। ওই ইউনিটের একজন চিকিৎসক বলেছেন, ‘আমরা প্রত্যেক রোগীর খুব কাছে থাকি। সংস্পর্শে আসা ছাড়া অস্ত্রোপচার সম্ভব নয়। কিন্তু যে সুরক্ষা আমাদের নেওয়া উচিত, তার সুযোগ কম।’ তিনি আরও বলেন, ঢাকা মেডিকেলেরও পরিস্থিতি যেকোনো দিন মিটফোর্ডের মতো হতে পারে।

গতকাল মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও ঢাকা মেডিকেলের পরিচালকের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সীমিত সেবা

কিশোরগঞ্জে এ পর্যন্ত ১৯৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৬ শতাংশই স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁরা জেলা সদর হাসপাতাল ও ১৩টি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের চিকিৎসক বা নার্স। চার দিন আগের হিসাবে দেখা যায়, আক্রান্ত ৮৯ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে চিকিৎসক ৪১ জন, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ৪৮ জন।

জেলার করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা আপাতত বন্ধ আছে। এই হাসপাতালের ৭ জন চিকিৎসকের করোনা শনাক্ত হয়েছে। বাকি ৭ জন চিকিৎসক কোয়ারেন্টিনে। আগে থেকেই বেসরকারি ক্লিনিকগুলো বন্ধ আছে। জেলার ইটনা, মিঠামইন, তারাইল, কটিয়াদী ও ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র কার্যত বন্ধ আছে। এসব কেন্দ্রের অনেক চিকিৎসক আক্রান্ত, কেউ কেউ কোয়ারেন্টিনে।

সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের রোগীর কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর ওই বিভাগের ১৯ জন চিকিৎসকসহ ৪৪ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।

এসব হাসপাতালের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

কেন এমন হলো

মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনি বিভাগে কেন এমন পরিস্থিতি হলো? কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালকে কেন লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে যেতে হলো?

একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের সুরক্ষার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে হাসপাতালগুলোর জন্য বিশেষ কোনো পরিকল্পনা করেনি।

নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণের খবর প্রথম শোনা যায় ডিসেম্বরের শেষ দিকে। চীনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে। বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। আর কমিউনিটি সংক্রমণ দেখা দেয় এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে। চার মাসের মতো সময় পেলেও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখা যায়নি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, অনেক সময় রোগী করোনার বিষয়টি গোপন রাখেন। চিকিৎসক সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন। অনেক সময় সেবা প্রদাকারীরাও বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন। এ ছাড়া সুরক্ষাসামগ্রীর মান ও এর ব্যবহার নিয়েও নানা অভিযোগ আছে। তিনি বলেন, সর্বোপরি ভাইরাসটির গতি–প্রকৃতির ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা কারও নেই। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা সবক্ষেত্রে সবার জন্য দরকার।

করণীয়

উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সুরক্ষাসামগ্রীর পাশাপাশি তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত হলে তাঁরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। সংক্রমণ থেকে দূরে থাকবেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম প্রাদুর্ভাব কেন্দ্র চীন ইতিমধ্যে পরিস্থিতি অনেকটা সামলে নিয়েছে। চীনে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবার জন্য কাজের পালা নির্দিষ্ট করা হয় ৭ দিনের জন্য। একদল স্বাস্থ্যকর্মী ৭ দিনের জন্য কাজ করবেন। এরপর তাঁরা ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। কোয়ারেন্টিন শেষে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আবার ৭ দিনের জন্য কাজে আসবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে ছুটি ও বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোভিড-১৯ রোগের জন্য নির্ধারিত রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

তবে সাধারণ হাসপাতালের জন্য ব্যবস্থা অন্য রকম হতে হবে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, হাসপাতালে রোগী যাঁরা পরীক্ষা করবেন, তাঁদের মানসম্পন্ন পিপিই ও এন৯৫ মাস্ক পরতে হবে। সন্দেহ হলে রোগীকে আইসোলেশনে রেখে নমুনা পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কোভিড-১৯ শনাক্ত হলে নির্দিষ্ট হাসপাতালে পাঠাতে হবে।

ঢাকা মেডিকেলের অর্ধেক অংশকে কোভিড-১৯–এর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাকি অর্ধেক অংশে অন্য রোগীদের চিকিৎসা হবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই হাসপাতাল এখন সবচেয়ে ঝুঁকিতে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চীন বা অন্য দেশের অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ ছিল। অন্যদিকে দেশের জনস্বাস্থ্যবিদদের নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনারও দরকার ছিল। এর কিছুই হয়নি। এর খেসারত এখন দিতে হবে দেশবাসীকে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button